দেশের গানে নাড়ীর টান

এ দেশে থেকে কী হবে? নিরাপত্তা নাই কোনো সুযোগ-সুবিধা নাই। ফালতু দেশ! এমন কথা প্রায়ই আমরা বলি ও শুনি। শুনে হয়তো সম্মতিসূচক মাথাও নাড়ি। ওই মুহূর্তে যদি কানে আসে একটা গান, ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো এমন করে আকুল হয়ে আমায় তুমি ডাকো…’ কীসের নিরাপত্তা আর কিসের সুবিধা! মন আকুল হয়ে ওঠে দেশপ্রেমে।

নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ ও পালনের একটা মাধ্যম এই দেশাত্মবোধক গান। দেশের হাওয়া হয়ে ওঠে সুর আর মাটি হয় কথা। কথা আর সুরের এই সংমিশ্রণ যেকোনো মানুষের মনকে তাই দেশের প্রতি দরদে ভিজিয়ে তোলে। কোনো একজন মানুষ না, কোনো নিশ্চিত ঘর না, শুধু দেশের কথা ভেবে মানুষ উদাস হয়। দেশের খাল-বিল, নদী-নালা, ফসল কেটে ফেলার পরের মাঠ, সুপারি-বাগানের গন্ধ, এ সব কিছুই একটা দেশের ছবি। একটা গন্ধ বা একটা হাওয়া বা অচেনা একটা রাস্তাও মানুষের মনে দেশ হিসেবে চিত্রিত থাকে।

দেশাত্মবোধের গানে তাই সেই মাটির ডাক শুনতে পান শ্রোতারা। সব না-পাওয়া ভুলে তাই গেয়ে ওঠেন, তোমার কথায় হাসতে পারি তোমার কথায় কাঁদতে পারি, মরতে পারি তোমার বুকে বুকে যদি রাখো আমায়, মাগো,- দেশের প্রতি এই সমর্পণ মানুষকে ঠিকানার বোধ এনে দেয়, দেয় শিকড়ের টান। মেরুদ- সোজা করে মানুষ উঠে দাঁড়ায়। কোথায় দাঁড়াচ্ছে, ধ্বংসস্তূপে নাকি জ্বলন্ত অঙ্গারে তা মনে থাকে না এই প্রেমিকের মনে। সে সব জয় করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের একেক ঋতুর একেক রূপ একেক গন্ধ একেকটা রোদের ছোঁয়া। গানের কথায় তাই আসে বাংলার রূপের বর্ণনা। ‘বাংলা মায়ের রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে’। দেশকে ‘মা’ বলা হয় গানের কথায়। এ মা কিন্তু আবার নারী না। এখানে জেন্ডারের কোনো বিষয় নেই। এই মায়ের আছে শুধু মমতা। যে মমতা এই দেশের মানুষের মনের খুব গভীরে ঘুমিয়ে থাকে দেশের জন্য।

কারও কাছে হয়তো দেশ মানে শুধু একটা মুখ। একটা প্রিয় মুখ, হয়তো মায়ের হয়তো পিতার। হতে পারে অচেনা কার একটা মুখ। হতে পারে পুকুরে ডুব দিয়ে উঠে ভেজা চুলে হেঁটে যাওয়া এক নারীর মুখ। কারও কাছে দেশ মানে ট্রেনের জানালায় বসা অচেনা এক কিশোরীর আনমনা চোখ। আঁতুড় ঘরে তুষ দিয়ে জ্বালানো আগুনের মালসাটাই হয়তো কার কাছে দেশ! দেশ ছাড়া মানুষ অসহায়, উদ্বাস্তু। এদিক- সেদিক ছুটে বেড়ানো যাযাবর। দেশের গানে তাই দেশকে দেওয়া হয় সেই আবেগের মালার সম্মান। শিল্পী গেয়ে ওঠেন, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট সোনার গাঁয়’।

ভাবি, কারা লেখে এসব গান? কাদের মনে এমন শব্দ এসে দোলা দেয়, কারা সুর বসায় এসব শব্দে? এ দেশের আলো হাওয়ায় বড় হওয়া শিল্পীদের পক্ষেই সম্ভব এসব গান বাঁধা। তরুণ ছেলেমেয়েদের একটা দল ট্রাকে করে ঘুরে ঘুরে গান করত মুক্তিযুদ্ধের সময়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে বাজত নিত্যনতুন সব গান। রোজনামচার মতো এসব গান লেখা হতো তখন। সেসব অকুতোভয় শিল্পীরা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় নয়, শুধু মনের তাগিদে গান বাঁধতেন। বরং তাদের ছিল জীবননাশের ভয়। একটি ন্যায় প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে যারা গান গেয়ে, কবিতা লিখে, মত প্রকাশ করে নিজেদের তরফের যুদ্ধটা করেছেন তারা আর যাই হোক কিছু পাওয়ার আশায় তা করেননি। স্বাধীনতা নিঃসন্দেহে বস্তুগত কিছু নয়। তারা অবশ্যই এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।

মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশাত্মবোধক গানগুলো আমাদের যোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছিল। করবেই বা না কেন? ‘পুর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ ‘তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’, ‘একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’-এ গানগুলো শুনলে শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলেরাও একটা ফুলের হাসির জন্য অস্ত্র ধরে জীবন বাজি রাখতে পারবে, এমনি শক্তিশালী এসব গান। মনের ভেতরের প্রেমকে জাগিয়ে তুলে দিয়ে ভয়কে ধুয়েমুছে দিতে পারে এসব গান।

এখনও এ গানগুলো সমান জনপ্রিয়। নতুন প্রজন্মের কাছে এ গানগুলোই তুলে ধরে ইতিহাস। যে ইতিহাস হয়তো বইয়ের ছাপার অক্ষরেও লেখা হয় না। সুরে আর কথায় শুনতে পাওয়া যায় কত প্রাণ আর কত রক্ত মিশে আছে এই মাটিতে। মুক্তির মন্দির সোপানতলে কত প্রাণ বলি হয়েছে অশ্রুজলে, সে কথা লেখা আছে এসব গানে। আর এ দেশের মাটিতে মিশে আছে সেসব যোদ্ধাদের শরীরের ভগ্নাংশ। ‘দে না তোরা দে না, সে মাটি আমার অঙ্গে মাখিয়ে দে না।’

– জন্ম আমার ধন্য হলো- গীতিকার: নয়ীম গহর, সুরকার: আজাদ রহমান
– একবার যেতে দে না- গীতিকার: গাজী মাজহারুল আনোযার, সুরকার: আনোযার পারভেজ
– পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে- গীতিকার: গোবিন্দ হালদার , সুরকার: সমর দাস
– মোরা একটি ফুলকে- গীতিকার: গোবিন্দ হালদার, সুরকার: আপেল মাহামুদ
– ও আমার বাংলা মা তোর- গীতিকার: আবুল ওমরাহ মো. ফখরুদ্দিন, সুরকার: আলাউদ্দিন আলী
– তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর- সুরকার ও গীতিকার: আপেল মাহমুদ
– মুক্তির মন্দির সোপানতলে- গীতিকার: মোহিনী চৌধুরী, সুরকার: কৃষ্ণচন্দ্র দে
– যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে- গীতিকার: নাসিম খান, সুরকার: সেলিম আশরাফ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অনুপ্রেরণা কাজকর্ম ভিতর-বাহির স্টার

নির্মাতা আদনান আল রাজীবের পছন্দের পাঁচটি বিজ্ঞাপন

হালচর্চা ডেস্ক ♦ আদনান আল রাজীব বর্তমান সময়ের অন্যতম সফল বিজ্ঞাপন নির্মাতা। তিনি ১৯৮৭ সালের ১১ মে টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০১১ সালে সিলন চায়ের বিজ্ঞাপন দিয়ে তার বিজ্ঞাপন নির্মাণের যাত্রা শুরু করেন। বর্তমানে তিনি নিজের প্রোডাকশন হাউজ ‘রানআউট ফিল্মস’-এর দায়িত্ব পালন করছেন এবং এরই মধ্যে একশটিরও বেশি টিভিসি নির্মাণ করেছেন। আলাপচারিতায় তিনি শেয়ার করেছেন […]

Read More
অনুপ্রেরণা কাজকর্ম গল্পগুজব ফ্যাশন ভিতর-বাহির স্টার

“অভিনয়ে আসবো ভাবিনি, শুধু ভাবতাম যদি মডেল হতে পারতাম”

হালচর্চা ডেস্ক ♦ রোখসানা আলী হীরা  ডাকনাম হীরা। জন্ম ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলায়। লাক্স চ্যানেল আই ফটোসুন্দরী প্রতিযোগিতায় ২০০৮ সালে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন মডেল তারকা রোখসানা আলী হীরা। ৫ ফুট ৬ ইঞ্চির এই মডেল লাক্স তারকা হিসেবে মিডিয়াতে প্রবেশ করলেও র‍্যাম্প মডেলিংকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ‘ঢাকা ফ্যাশন উইক’ ২০১২ সালে তাকে বেস্ট র‍্যাম্প […]

Read More
অনুপ্রেরণা কাজকর্ম গল্পগুজব ভিতর-বাহির

সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন: নতুন পেশা

হালচর্চা ডেস্ক ♦ বাংলাদেশে খুব শুরুর দিকে যারা ইন্টারনেট মার্কেটিং, বিশেষত এসইও নিয়ে কাজ করছেন আসিফ আনোয়ার পথিক তাদের অন্যতম। তবে ইদানিংকার ফ্রীল্যান্স-ভিত্তিক এসইও নয়, তিনি মুলত কাজ করেছেন কর্পোরেট-ভিত্তিক বিজনেস কন্সালটেন্সি নিয়ে। বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপি এর যৌথ উদ্যোগে এটুআই প্রকল্পের সাথে ওয়েব অপ্টিমাজেশনের জন্য ন্যাশনাল কন্সালটেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন অনেকদিন। আসিফ আনোয়ার ইন্টারনেট […]

Read More