আলিয়া আজাদ
প্রেমিক-প্রেমিকা অথবা স্বামী-স্ত্রী খুব মধুর সম্পর্ক। এই পৃথিবীর বেশিরভাগ সম্পর্ক পূর্ব থেকে নির্ধারিত যেমন: বাবা-মা-সন্তান, ভাই-বোন ইত্যাদি। কারণ এগুলো রক্তের সম্পর্ক। কিন্তু ভালোবাসার সম্পর্ক মনের অনুভূতি থেকে তৈরি। এই সম্পর্ক এক দেখাতেও হতে পারে আবার বহুদিন একে অপরের ব্যক্তিত্বের প্রতি ভালো লাগা থেকেও হতে পারে। প্রতিটা সুন্দর সম্পর্কের মতো এই সম্পর্কগুলোও খুব যত্ন করে লালন করতে হয়। সম্পর্কের লালন বা যত্ন বলতে কিন্তু শুধু প্রিয় বা মধুর বা সুন্দর বিষয় চর্চা করাই নয়। সঙ্গীর ভুল শুধরে দেয়াও সম্পর্কের সুখ ধরে রাখার হাতিয়ার হতে পারে। কিন্তু অপ্রিয় কথা সবসময় তেঁতো হয়। আমরা সবাই শুধু প্রিয় কথা শুনতে চাই, প্রশংসা পেতে চাই। কিন্তু এতে সম্পর্কের ভারসাম্য নষ্ট হয়। কখনও কিছুটা অসুন্দর, অপ্রিয়’র উপস্থিতি দরকার তবে শোভন উপায়ে।
একটা মানুষের সব বিষয়ে পারদর্শিতা থাকে না। সব গুণ নিয়ে এই পৃথিবীতে আমরা আসিনি। এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি আমাদের ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে। আমাদের স্বভাব, অভ্যাস ধীরে ধীরে শৈশব থেকে গড়ে উঠে। সঙ্গী নির্বাচনের সময় আমাদের বয়স যৌবনে পদার্পন করে। আমাদের পছন্দ- অপছন্দ, ভালো-মন্দ অভ্যাস ততোদিনে পরিপক্ক অবস্থানে পৌঁছে যায়। একেক পরিবারের নিয়ম, বিশ্বাস একেক রকম। সবাই একই বিষয়কে সমান প্রাধান্য দেয় না। যা দেখে বড় হই তাই আমরা জীবনে চর্চা করি। তাই আমাদের কাছে কিছু অভ্যাস স্বাভাবিক যদি সেটা অন্যের নজরে ভালো নাও হয়। মানুষের আদর্শ, ভালো-মন্দের বিচার, আবেগের বহিঃপ্রকাশ নির্ভর করে তার জীবন চর্চা, শিক্ষা, বিশ্বাসের উপর।
দু’জন মানুষ দু’টি ভিন্ন অবস্থান থেকে আসে। তাদের বড় হয়ে ওঠা, বিশ্বাস, আদর্শ আলাদা হবে এটাইতো স্বাভাবিক। দুজনের চিন্তা-চেতনায় তফাত হতেই পারে। কিন্তু সম্পর্ক কিছুটা রেল লাইনের মতো। তাল মেলানো খুবই জরুরী আবার কিছুটা দূরত্বও দরকার। নইলে দুজনের পথ এক দিকে এগিয়ে যাবে না।
ভালো-মন্দের একটা মাপকাঠি আছে যা মোটামুটি আমরা সবাই জানি কিন্তু মানতে চাই না। অথবা কারও কারও ক্ষেত্রে নিজের অপ্রিয় স্বভাবগুলো অনুভব করার ক্ষমতার উন্নতি হয় না। এতে সম্পর্কের ছন্দপতন ঘটে। এতে অন্যদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
অতিরিক্ত রাগ, সমালোচনা, শারিরীক-মানসিক আঘাত, অসম্মান, অপমান, অযথা সন্দেহ, চাপিয়ে দেয়া, দাবিয়ে রাখা এরকম অনেক অপ্রিয় স্বভাব আমাদের মাঝে আছে যা আমরা এড়িয়ে যেতে চাই। কারণ এই স্বভাব আমাদের সাময়িক প্রশান্তি দেয়। এবং কেউ কেউ একে পরিস্থিতি মোকাবিলা বা আধিপত্য ধরে রাখার উপায় মনে করেন। তারা এই কনসেপ্ট লালন করেই এতোদিন চলেছে। এই ব্যাখ্যা, বা আইডিয়ার বাইরে আর কোন ফলপ্রসূ উপায় থাকতে পারে তা তাদের কাছে অজানা।
অবশ্যই এই অপ্রিয় বিষয় তাদের সামনে তুলে ধরবার প্রয়োজন আছে। তবে ঘৃণার বিনিময়ে ঘৃণা অথবা মারের বিনিময়ে মার নয়। এটা সম্পর্কের ময়দান, যুদ্ধ ক্ষেত্র নয়। এই সম্পর্ক ভালোলাগা, ভালোবাসার অনুভূতি থেকে তৈরি। এখানে পরিবর্তন এর চেষ্টার ক্ষেত্রে কিছু উপায় অবলম্বন করা যেতে পারে। যেমন:
মেজাজ বুঝে উপস্থাপন
অপর পক্ষের মেজাজ বুঝে সঠিক সময়ে তার ভুলগুলো উল্লেখ করা যেতে পারে । সাধারণত অপ্রিয় কথা কারও ভালো লাগে না। মেজাজ খারাপ অবস্থায় মানুষের গ্রহণ ক্ষমতা কমে যায়। আর নিজের নেতিবাচক সমালোচনা মেজাজের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। তাই সঙ্গীর মেজাজ ভালো আছে এমন সময় বলা যেতে পারে।
যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়া
কেন এই বিষয়টা অপ্রিয় তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে হবে। তাহলে অপরপক্ষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। “আমি পছন্দ করি না” এই ধরনের অযৌক্তিক কথা এখানে দূর্বল ভূমিকা পালন করবে । এছাড়াও যুক্তি না থাকলে মানুষ পরিবর্তনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
লাভ-ক্ষতির হিসাব
অপ্রিয় বিষয় সাধারণত ক্ষতি ডেকে আনে। এটা সম্পর্ক যেমন নষ্ট করে তেমনি পরিবেশের আবহ নষ্ট করে। এতে সে সবার কাছে অপ্রিয় হচ্ছে এবং মন থেকে সবাই ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। হয়তো কিছু মানুষ ভয়ে তাকে উপরে উপরে সম্মান দেখাবে কিন্তু সত্যিকার অর্থে সে সম্মান হারাবে। সে প্রিয়জনদের ভালোবাসা হারাবে।
সাধারণত প্রতিটা মানুষের জীবনেই খুব ভালোবাসার কিছু সম্পর্ক থাকে যাদের ভালোর জন্য সে সবই ত্যাগ করতে রাজী থাকে। সব পরিবর্তনেই আগ্রহী হয়। তার অপ্রিয় বিষয় পরিবর্তনে ভালোবাসার সম্পর্কের ক্ষেত্রে কী উপকার হতে পারে বা কী ক্ষতি হচ্ছে তা তুলে ধরা জরুরী।
এই বিষয়গুলো সঙ্গীকে বুঝতে হবে।
সামাজিক পরিবেশ
যে সম্পর্কে অনেক অপ্রিয় বিষয় থাকে, তারা অপ্রিয় ঘটনা বার বার ঘটায় এবং অনেক সময় তা অন্যদের সামনেও করে যা সামাজিক পরিবেশ নষ্ট করে। অথবা চার দেয়ালের ভিতরেও যদি হিংস্রতা দেখা দেয়, তার প্রভাব বাইরেও পড়ে। সমাজের অন্যান্য মানুষেরা এর দ্বারা মানসিকভাবে ক্ষতির শিকার হয় । এই বিষয়গুলো উল্লেখ করা যেতে পারে।
শারিরীক-মানসিক অবস্থা
অপ্রিয় আচরণ যে করে সে নিজেও মানসিকভাবে ভালো থাকে না। এই আচরণ সে হয়তো পরিবার থেকে শিখেছে নাহয় কখনও আচরণ দ্বারা লাভবান হয়েছে। তাই চর্চায় এই আচরণ বর্তমানে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সাধারণত যারা দুশ্চিন্তাপ্রবণ ব্যক্তিত্ব, তারা সহজেই অস্থির হয় এবং খারাপ ব্যবহার করে। এবং পরবর্তীতে অপরাধবোধে ভোগে। এটাই যখন প্রতিনিয়ত চলতে থাকে তা মানসিক ও শারিরীক ক্ষতির কারণ হয়। এই বিষয়গুলোও সঙ্গীর সামনে তুলে ধরতে হবে।
ভালোবাসা, ভালো ব্যবহার, নমনীয়তা, অধিকার নিয়ে কারও ভালো চাওয়া অনেক অসুন্দরকেও সুন্দরে পরিবর্তন করতে পারে। প্রথমেই ঢাল-তলোয়ার নিয়ে নয়, ভালোবাসার তীর দিয়ে চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এটাই ইতিবাচক পরিবর্তনের সম্ভাব্য উপায়।
লেখক: সিনিয়র কাউন্সিলর
এভারকেয়ার হসপিটাল, ঢাকা।