তানিয়া ইসলাম ♦
মডার্ন টাইমস নামটি এই সিনেমার জন্য একদম উপযুক্ত। এটি এমন একটি শক্তিশালী গল্প বলে যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের সময় মানুষ যেভাবে অমানবিক জীবনধারা গ্রহণ করেছিল, তা তুলে ধরে। এই যুগটি ইতিহাসের একটি বিশাল মোড় ছিল, যা প্রতিদিনের জীবনের প্রায় সব দিককে প্রভাবিত করেছিল। একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে মডার্ন টাইমস সিনেমাটি আধুনিক শিল্পায়নের কঠিন বাস্তবতার সমালোচনা করে, যেখানে মেশিন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। সিনেমার মানুষগুলো মেশিনের মতো আচরণ করে—এই ধারণা চার্লি চ্যাপলিন কৌতুকের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, যা আমাদের হাসায় কিন্তু সেই গভীর সত্যকে ভুলতে দেয় না।
সিনেমার প্রথম দৃশ্যটি অসাধারণ একটি রূপক। আমরা দেখি কিছু শূকর রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, কিন্তু তারা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায় এবং আমরা দেখি কিছু শ্রমিক তাদের কারখানায় দৌড়াচ্ছে। বার্তাটি স্পষ্ট: ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের পরে মানুষ যেন গবাদি পশুর মতো হয়ে গেছে—কাজ করে, খায়, দৌড়ায়—কিন্তু ভালোবাসতে, স্বপ্ন দেখতে বা দয়া করতে ভুলে গেছে। জীবন একটি সরল সমীকরণে নেমে এসেছে: যার অর্থ এবং ক্ষমতা আছে, সে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, যার নেই। আরেকটি অত্যন্ত প্রতীকী দৃশ্য ছিল যখন চ্যাপলিনকে “খাওয়ার মেশিন” পরীক্ষা করতে বাধ্য করা হয়। উপরিভাগে এটি হাস্যকর হলেও ভেতরের বাস্তবতা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক। চ্যাপলিন এতে অংশ নিতে চায় না, কিন্তু একজন দরিদ্র শ্রমিক হিসেবে তার কোনো অধিকার নেই। সে কেবল একটি মেশিনের অংশ, নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার মতো ক্ষমতা নেই, যদি না সে নিজেই পুরো সিস্টেম থেকে বেরিয়ে আসতে চায়।
এই সামাজিক সমালোচনার পাশাপাশি একটি হৃদয়স্পর্শী প্রেমের গল্পও রয়েছে। বাবার মৃত্যুর পর মেয়েটি একা হয়ে যায়, এবং তার জীবনে আসে চ্যাপলিন—সেই চ্যাপলিন, যে কিছু না করে জেলে খাবার এবং শয্যার জন্য থাকতে চেয়েছিল। সে অলস ছিল নাকি তার ভাগ্যই খারাপ ছিল, তা বলা মুশকিল। তারা একসাথে স্বপ্ন দেখে, নিজেদের একটি বাড়ি হবে। তারা কাজ খুঁজতে শুরু করে, আর একটি রেস্তোরাঁয় চ্যাপলিন গান ছাড়াই একটি অদ্ভুত গান গায়, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে। কিন্তু আবারও—ভাগ্য! অনাথ আশ্রমের কর্তৃপক্ষ মেয়েটিকে নিতে চায়। তারা পালায়, একে অপরের হাত ধরে। পরের দিন সকালে তারা একসাথে পাহাড়ের দিকে হাঁটতে থাকে, তাদের স্বপ্ন এবং একে অপরকে আঁকড়ে ধরে।
শেষ পর্যন্ত, চ্যাপলিন এবং মেয়েটি এই আধুনিক যুগের জন্য উপযুক্ত ছিল না। মেশিনের তৈরি এই যান্ত্রিক, নির্দয় জীবন তারা মেনে নিতে পারেনি। তারা এই কঠিন সত্যকে গ্রহণ করতে পারেনি, তাই তারা তাদের সুখ এবং স্বপ্ন পূরণের আশায় শহর ছেড়ে চলে যায়। এমন একটি গল্পের এর চেয়ে ভালো সমাপ্তি আর কী হতে পারে!
এই হাস্যরস, ভালোবাসা এবং সামাজিক সমালোচনার সংমিশ্রণ মডার্ন টাইমস সিনেমাটিকে একটি অবিস্মরণীয় চলচ্চিত্রে পরিণত করেছে, যা আজও আমাদের মনকে স্পর্শ করে।