সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন: নতুন পেশা

হালচর্চা ডেস্ক

বাংলাদেশে খুব শুরুর দিকে যারা ইন্টারনেট মার্কেটিং, বিশেষত এসইও নিয়ে কাজ করছেন আসিফ আনোয়ার পথিক তাদের অন্যতম। তবে ইদানিংকার ফ্রীল্যান্স-ভিত্তিক এসইও নয়, তিনি মুলত কাজ করেছেন কর্পোরেট-ভিত্তিক বিজনেস কন্সালটেন্সি নিয়ে। বাংলাদেশ সরকার ও ইউএনডিপি এর যৌথ উদ্যোগে এটুআই প্রকল্পের সাথে ওয়েব অপ্টিমাজেশনের জন্য ন্যাশনাল কন্সালটেন্ট হিসাবে কাজ করেছেন অনেকদিন। আসিফ আনোয়ার ইন্টারনেট মার্কেটিং বিষয়ে একজন সফল ট্রেইনার, বক্তা, এবং ব্লগার। এসইও এর জন্য জগতখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন জার্নালসহ অন্য আরও ইন্টারনেট মার্কেটিং-ভিত্তিক ওয়েব ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখক।

হালচর্চার সাথে সাক্ষাৎকারে এসইও নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছেন আসিফ আনোয়ার পথিক।

SEO কী?আপনি SEO এর সাথে কীভাবে জড়ালেন?

পথিক: ধরুন আপনার একটি গার্মেন্টস এক্সপোর্ট ব্যবসা আছে। আপনার বেশিরভাগ ক্রেতা বিদেশী। বাইরের দেশে বেশির ভাগ মানুষ গুগল বা বিং ব্যবহার করে “Garments Exporters from Bangladesh” সার্চ দেয়। সার্চ দেবার পর যদি আপনার সাইট খুজে পায়, তাহলে আপনার কাছে কিছু অর্ডার চলে আসে। তা না হলে, এসব ক্রেতাদের সাথে আপনার যোগাযোগ কখনই হবে না। “Garments Exporters from Bangladesh” হচ্ছে কিওয়ার্ড, যা দিয়ে ক্রেতারা সার্চ করছে। আর এই কিওয়ার্ডের জন্য আপনার সাইটকে গুগল বা বিং-এ প্রথম ১০টি সাইটের লিস্টে আনার জন্য কাজগুলোকে সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাজেশন বা সংক্ষেপে এসইও বলে।

২০০১ সালে আমি প্রথম আমার ওয়েবসাইট বানাই, পরে সেটা হোস্টও করি। কিন্তু, নিজের নামে সার্চ করলে সাইটটা খুজে পাওয়া যেত না বলে খুব খারাপ লেগেছিল। তখন ওটা করতে গিয়ে, কিছু কৌশলের সাথে পরিচিত হই। আর ওটা করেই নিজের সাইটকে গুগলে ইনডেক্স করাই। মজার ব্যাপার হলো, “সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাজেশনশব্দটা তখনও ব্যবহার শুরু হয়নি। কারন, ডেনি সুলিভান প্রথম শব্দটা ব্যবহার করেন ২০০৩ সালে। তারপর থেকেই ২০০৩ সাল থেকে অনেক রিসার্চ হতে থাকে সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাজেশন নিয়ে। তাই, অনেকটা শুরু থেকেই এর সাথে আছি। আর এই ক্ষেত্র এতবেশি পরিবর্তনশীল যে, সবসময় পড়াশোনার উপরে থাকতে হয়। তাই আজও পড়াশোনা করে যাচ্ছি।

 

অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং এর সাথে SEO এর সম্পর্ক কি?

পথিক: অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং হল একটি স্বতন্ত্র ব্যবসা, যেখানে আপনার বিক্রিত পন্যের মালিক অন্য কেউ। মানে, আপনি বড় কোনো কোম্পানির পণ্যের মার্কেটিং প্রতিনিধি। আজকাল অনেক পণ্য অনলাইনে বিক্রি হয়। আপনি কোনো বড় একটা কোম্পানির পণ্য অনলাইনে বিক্রি করে দিতে পারলে তারা আপনাকে ভালো একটা কমিশন দেয়। আর এভাবেই অনেকে অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং এর কাজ করে যাচ্ছে। তবে বিক্রি বাড়াতে হলে আপনাকে কোয়ালিফাইড ট্র্যাফিক আনতে হবে আপনার সাইটে বা অ্যাফিলিয়েটেড কোম্পানির সাইটে। কোয়ালিফাইড ট্র্যাফিক হলো, এমন কিছু ক্রেতা বা ইচ্ছুক লোকজন, যারা আপনি যা বিক্রি করতে চাচ্ছেন, তাই কিনতে ইচ্ছুক। কিন্তু, তার জন্য প্রথম কাজ যেটা লোকজন করে, তা হলো গুগল বা বিং এ সার্চ করে। আর সার্চ করে যদি আপনার বা কোম্পানির সাইট পায়, তখন অনলাইনে অর্ডার দেয়। আর তাই, অ্যাফিলিয়েটেড মার্কেটিং-এ সফল হবার জন্য সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাজেশন একটা মুল কৌশল হিসাবে কাজ করে। আপনার সাইটে ট্র্যাফিক আনার আরো অনেক কৌশল থাকলেও, কেবলমাত্র সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাজেশন সঠিক সময়ে, সঠিক লোকের মাঝে, সঠিক বার্তা পৌছে দিতে পারে (Right message in the right time to the right people).

 

বাংলাদেশে SEO করার মতো দক্ষ কর্মী কি আছে? কোন দেশগুলো বাংলাদেশের কর্মীদের প্রতি আগ্রহী?

পথিক: ২০১২ সালে ওডেস্কের ম্যাট কুপারের সাথে কথা বলার এক পর্যায়ে আমাকে জানান যে, ওডেস্কে যত এসইও-এর কাজ হয় তার ২৫% এখন বাংলাদেশ থেকে হচ্ছে। যদি কোয়ান্টিটির কথা বলেন, আমাদের দেশ কোয়ান্টিটি কাজের জন্য স্বর্গরাজ্য। কিন্তু, কোয়ালিটি কাজের জন্য বাংলাদেশের মার্কেট এখনও পরিপক্ক হয়ে উঠেনি। তবে আমি বেশ আশাবাদী যে আগামী ৫ বছরে আরও পরিপক্ক হবে এই ইন্ডাস্ট্রিটি।

তবে, ইংলিশ লিটারেসি কম হওয়ায়, ইংলিশে আর্টিকেল লেখার জন্য ভালো লোক খুজে পাওয়া যায় না। আর অল্পবিস্তর যারা ভালো লিখেন, ওদের চাহিদা বেশি থাকায়, বেশি মূল্যে অন্য কিছুতে নিয়োজিত আছেন। তবে, এসইও এর জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোয়ান্টিটি বা ক্ল্যারিক্যাল কাজের চাহিদা আছে। এই কাজগুলো বাংলাদেশে প্রচুর আসে। কারন বাংলাদেশে আইটি শ্রমিক বেশ সস্তা।

আর সস্তা হবার কারনে নানান দেশ থেকে বাংলাদেশী আইটি শ্রমিকদের অনেক চাহিদা রয়েছে। শুধু গুটিকয়েক দেশের নাম বললে ভুল হবে। তবে, আমাদের দেশ থেকে যাদের আইটি শ্রমিকদের পারিশ্রমিক বেশি, সেসব দেশ থেকেই অর্ডার আসে বেশি।

 

বাংলাদেশের ইন্টারনেট কানেকশন কি SEO করার জন্য সহায়ক?

পথিক: গ্রাফিক ডিজাইন বা ভিডিও এডিটিং এর জন্য বেশি ব্যান্ডউইথের দরকার হলেও, সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাজেশনের জন্য তত বেশি ব্যান্ডউইথের দরকার হয় না। অবশ্য সাধারন ব্রাউজিং এর জন্য যতটুকু দরকার, তার চেয়ে একটু বেশি দরকার হয়। এখানে যেসব কাজ আসে, সেগুলোর জন্য নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগের দরকার হয়। বাংলাদেশে নিরবিচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সংযোগ খুব একটা বিরল না হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকের অভিজ্ঞতা খারাপ। আর, নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের ব্যাপারটা বিরল হওয়ায়, বাংলাদেশে এসইও নিয়ে কাজ করতে হলে অনেক বেশি সমস্যা হয়। তবে সব মিলিয়ে, ক্ল্যারিক্যাল এসইও কাজের জন্য বাংলাদেশ অন্য যেকোনো দেশের থেকে বেশ ভালো স্থানে আসীন আছে।

 

SEO-কে ফুলটাইম পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব?

পথিক: অবশ্যই সম্ভব, আমি নিয়েছি ২০০৩ সাল থেকেই। কিন্তু একটা জিনিস মাথায় রাখতে হবে: এই বিদ্যা সাময়িক। কারন, আপনি যে কৌশল আজ শিখে ফেলছেন, তা ৬ মাস পর আর কাজ করবে না। আর যতদিন যাচ্ছে, ৬ মাসের এই গ্যাপ কমে যাচ্ছে। কারন, গতবছর লিখলে আমি ১ বছর গ্যাপের কথা বলতাম। ২ বছর পর হয়তো এটা ৩ মাসে নেমে আসবে। তাই, এই ইন্ডাস্ট্রিতে কামড়ে পরে থাকতে হলে আপনাকে প্রতিদিন, কিছু না কিছু পড়াশোনা করে যেতেই হবে। আপনাকে ইংলিশে লেখালেখির হাত বাড়াতে হবে। সেইসাথে আপনি যে ব্যবসার এসইও করতে চান, সেই ব্যবসার খুঁটিনাটিও শিখতে হতে পারে। কারন এসইও ধীরে ধীরে স্পেশালাইজেশনের দিকে ঝুঁকছে।

 

SEO শিখতে ইচ্ছুকদের জন্য প্রশিক্ষণের কোনো ব্যবস্থা আছে?

পথিক: বাংলাদেশে ২০০৯ সালের পর থেকেই এসইও এর উপর অনেকের আগ্রহ বেড়েছে। তার সাথে সাথে গড়ে উঠেছে অনেক ভাল-মন্দ প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানও। আগ্রহী এসব শিক্ষার্থীদের এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার জন্য ২০১০ সালে আমি ফেসবুকে বাংলাদেশ ইন্টারনেট মার্কেটিং প্রোফেসনালস অ্যাসোসিয়েশান (বিম্পা) গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করি। আর এখন ইন্টারনেট মার্কেটিং এর জন্য এটাই বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ফেসবুক গ্রুপ। এখান থেকে বিনামূল্যে সবাইকে এসইও-সহ ইন্টারনেট মার্কেটিং এর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও এখন বর্তমানে এসইও শেখার জন্য অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যার লিস্ট এখানে পাবেন।

 

কোন বিষয়ের দিকে নজর দিলে একজন দক্ষ SEO এক্সপার্ট হওয়া সম্ভব?

পথিক: একটা ব্যাপার হল: যতই দিন যাচ্ছে, ততই কঠিন হচ্ছে এসইও কৌশলগুলো। তাই, ন্যাটিভ ইংলিশভাষীদের মত লেখার হাত না থাকলে বা মার্কেট ভালো না বুঝলে, ভবিষ্যতে এসইও এর জন্য কাজ করা কঠিন হয়ে যাবে। তাই, আপনার ইংলিশ লেখার হাত ভালো না হলে এটাকে ফুলটাইম পেশা হিসাবে নেওয়ার আগে ভালভাবে চিন্তা করে নিন।

 

তবে শুধু লেখার দক্ষতা হলেই যে ভালো করা যায়, তা না। এসইও এর জন্য আপনাকে ৩টা বিষয়ে পারদর্শী হতে হয়:

সায়েন্স: সাইটের জন্য হাল্কা পাতলা কোডিং জানা, গুগল আর বিং এর প্রযুক্তির ব্যাপারে জানা। 

আর্টস: ইংরেজিতে বা অন্য ভাষায় এবং কাঙ্খিত বিষয়ে ভালো লেখালেখির হাত।

কমার্স: ট্র্যাফিকের সাইকোলজি বুঝে কোন ব্যবসাকে প্রসারের কৌশল জানা।

আপনি যেকোনো ২টা বিষয়ে যদি পারদর্শী হন, তাহলে অন্য আরেকটির জন্য অন্য কারো সাহায্য নিয়ে এসইও কে ফুলটাইম পেশা হিসাবে নিতে পারেন।

আবার, যে ব্যবসার ব্যাপারে আপনার কোন জ্ঞান নেই, সেসব ক্ষেত্রেও কঠিন হয়ে যাবে ভবিষ্যতে। যেমন, একটা মেডিকেল সামগ্রী বিক্রি করার সাইটের জন্য এসইও করতে হলে, আপনার মেডিকেল সায়েন্সের জ্ঞান থাকা দরকার। এসইও এর জন্য আপনাকে ইন্ডাস্ট্রি অথরিটি অর্জন করতে হয় বা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে ভালো বক্তা হতে হয়। আর ভালো কন্টেন্ট ছাড়া সেটা অর্জন করা মোটেও সম্ভব না। এটা ছাড়া বর্তমানে কাজ হলেও, ভবিষ্যতে হয়তো সম্ভব হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ওয়ার্কপ্লেস কাজকর্ম ভিতর-বাহির যাপন

নৌকার পাল তুলে দেয়ায় ক্যারিয়ার শেষ!

হালচর্চা ডেস্ক  ♦ সোহেল প্রতিদিন সঠিক সময়ে অফিসে যায়, তার দায়িত্বের কাজগুলো কখনই পড়ে থাকে না। প্রতিটি টাস্ক সে দিনেরটা দিনেই শেষ করে। কখনই সে ছুটির আগে অফিস থেকে বেরিয়ে যায় না। এ নিয়ে তার অফিসে সুনামও আছে, তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বেশ খুশি তার ওপর। তবে এভাবে কয়েক বছর যাওয়ার পর যখন তার পরে জয়েন […]

Read More
Uncategorized অনুপ্রেরণা কাজকর্ম ভিতর-বাহির স্টার

বাংলা র‍্যাপ: বিটের তালে সিধাসাদা কথা

রওশন আরা মুক্তা ♦ একুশ শতকের প্রথম দশকেই নতুন স্বাদের যে গান বাংলা ভাষাভাষিদের চাঙ্গা করেছে তা হলো বাংলা র‍্যাপ। নিউইয়র্ক বেজড স্টোয়িক ব্লিসের ‘আবার জিগায়’ নামের হিপহপ ঘরানার গানটি রিলিজের সাথে সাথেই শ্রোতাদের প্লে লিস্টে উঠে আসে; তবে প্রচুর ইংরেজি শব্দের ব্যবহারের কারণে একে পুরোপুরি বাংলা র‍্যাপ বলা যাবে না। একই ধারাবাহিকতায় ‘দেশি এমসি’জ’ ‘ব্যানড’ […]

Read More
কাজকর্ম গল্পগুজব ভিতর-বাহির স্টার

ভয়েস-অফ ভয়েস

দীপু মাহমুদ ♦ একটি পণ্যের বিজ্ঞাপনের শুটিং হবে। কীভাবে যেন অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর চলচ্চিত্রের এক নায়িকাকে ম্যানেজ করে ফেলেছে। এলেবেলে কোনো নায়িকা নয়। ঢালিউডের শাকিব খান, কলকাতার সিনেমার নায়ক দেব-য়ের সাথে অভিনয় করা তুখোড় নায়িকা। তাকে পাওয়ার পর আচমকা পাণ্ডুলিপি বদলে গেল। ঘটনা হয়ে গেল নায়িকা ফোকাসড। আমি বাবা। নায়িকা আমার কন্যা। বাসা থেকে আমাদের শুটিং […]

Read More