চিহ্ন ধরে খুঁজে ফেরার গল্প

তানিয়া রহমান

গল্প না বলে উপায় নেই আসলে বইটি পড়ে। লেখক ওয়াহিদ সুজন উকিল মুন্সীকে জানার জন্য যে খোঁজাখুঁজি করেছেন, সেই অভিজ্ঞতা তিনি লিখেছেন গল্প বলার ঢঙে। পাঠকের এ-ও মনে হতে পারে যে তিনি নিজেও সেই যাত্রার সাথি হয়ে নেত্রকোনার পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর এই গল্প বলার ঢঙের কারণেই বইটি হয়ে উঠেছে অনন্য। বইটির ভূমিকা লিখেছেন ফরহাদ মজহার। বাংলার নদীয়ার ভাবের সঙ্গে একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন তিনি ভূমিকাতে। উকিল মুন্সীর গানের প্রধান উপজীব্য বিচ্ছেদ, এমন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করেছেন ফরহাদ মজহার এখানে। আবার একই সঙ্গে নদীয়ার বিচ্ছেদ ভাবনার সঙ্গে এই বিচ্ছেদী ভাবের মিল ও অমিলগুলো ব্যাখ্যাসহ হাজির করেছেন। বইটি পড়ে উকিল মুন্সীকে জানা তো যাবেই, বাংলার ভাবের জায়গায় উকিল মুন্সীর কী অবস্থান, সেটা এই ভূমিকা থেকে কিছু অনুমান করা সম্ভব।

লেখক তার ভূমিকায় লিখেছেন, হুমায়ূন আহমেদ আমাদের উকিল মুন্সীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। প্রয়াত লেখক চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের সিনেমায় আমরা কিছু মাটির গন্ধমাখা গান শুনতে পেয়েছিলাম। ‘পূবালী বাতাসে’, ‘আমার গায়ে যত দুঃখ সয়’Ñএ গানগুলো তারই কল্যাণে আমাদের কর্ণগোচর হয়েছে। এই গানগুলো যিনি বেঁধেছিলেন, তিনিই উকিল মুন্সী। উকিল মুন্সীর চিহ্ন ধরে বইটির নাম নিয়ে বইয়ের প্রথম পর্বেই ব্যাখ্যা দিয়েছেন লেখক। কীভাবে তিনি উকিল মুন্সীকে জানতে আগ্রহী হলেন এবং সেই জানাটা কোন চিহ্ন ধরে শুরু করবেন, তেমন একটা জায়গা থেকে চিহ্ন হিসেবে তিনি কবরকে বেছে নিলেন। উকিল মুন্সীর কবর যেখানে, সেখান থেকেই শুরু হোক খোঁজা।

বইটি তিনটি পর্বে হাজির করেছেন লেখক। ‘ভ্রমি চিহ্ন ধরে’, ‘কার্তিক ও নাইওর’ ও ‘ছাপার অক্ষরে উকিল মুন্সী’।
প্রথম পর্বে এসেছে লেখকের চিহ্নকে গন্তব্য ধরে নিয়ে যাত্রার বর্ণনা। সেই যাত্রার অভিজ্ঞতার সঙ্গে লেখক সংযুক্ত করেছেন উকিল মুন্সীর বিভিন্ন গানের লাইন। এই পর্বে উকিল মুন্সীর খোঁজখবর করেন এমন লোকজনের সঙ্গে দেখা হওয়ার, কথা বলার অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে। এ পর্ব পড়তে গিয়ে পাঠক পরিচিত হবেন একটা লোকালয়ের সঙ্গে, উকিল মুন্সীর গানের সঙ্গে এবং উকিল মুন্সীর পরিচয়টাও এ পর্বে জানা যাবে।

উকিল মুন্সীর নামটা ‘গাতক’ হিসেবে একটু বেমানান সাধারণ অর্থে। কিন্তু যে অভিনব তথ্যটি এই বইয়ে অপেক্ষা করছিল তা হলো, উকিল মুন্সী একটি মসজিদের ইমামও ছিলেন, এবং তিনি একতারা বাজিয়ে গানও গাইতেন। নানা জন নানা রকম তথ্য দিলেও এটা পরিষ্কার যে উকিল মুন্সী খুব বেশি দিন আগের মানুষ নন। জন্মসাল না জানা গেলেও একটা সূত্রে জানা যায় উকিল মুন্সী মারা গেছেন ১৯৮০-৮১ সালের দিকে। ময়মনসিংহ অঞ্চলে একজন মসজিদের ইমাম একতারা বাজিয়ে গান করে জীবন কাটিয়ে গেছেন, এটা তথ্য হিসেবে খুবই চমকপ্রদ।
দ্বিতীয় পর্বে এসেছে উকিল মুন্সীর গানের ‘কার্তিক’ ও ‘নাইওর’ প্রসঙ্গে দার্শনিক আলোচনা। নেত্রকোনা অঞ্চলের হাওর অঞ্চলের জলের সঙ্গে রয়েছে ‘নাইওর’ যাওয়ার একটা সম্পর্ক। ময়মনসিংহ অঞ্চলে বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি বেড়াতে যাওয়াকে নাইওর যাওয়া বলে। মেঘ ছাড়া, জল ছাড়া যে নাইওর যাওয়া সম্ভব হয় না। এ জলের অর্থ কী, আর নদীয়ায় জলের কী অর্থ, এ ধরনের একটা তুলনামূলক আলোচনা করেছেন লেখক এ পর্বে। আবার অন্যদিকে কার্তিক মাসে জলের খেলা থাকে না। হাওর সে সময় যায় শুকিয়ে। জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে উকিলের গানে আষাঢ় আর কার্তিক ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক।

তৃতীয় পর্বে উকিল মুন্সীর গান বা উকিল মুন্সীর কথা ছাপার অক্ষরে কোথায় কোথায় প্রকাশিত হয়েছে, এ-সম্পর্কিত তথ্য লিপিবদ্ধ হয়েছে। হুমায়ূন আহমেদের মধ্যাহ্ন উপন্যাসে উকিল মুন্সীর পরিচয় কীভাবে লেখা হয়েছে, তা কতটুকু বাস্তব, কতটুকু কল্পনা, সেটাও এ পর্বে জানা যাবে।

উকিল মুন্সীর বিচ্ছেদী গানের সঙ্গে যারা পরিচিত, তাদের জন্য তো অবশ্যই, যারা বাংলার নানা রকম ভাবের গান শুনতে চান, বুঝতে চান, তাদের জন্যও এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

পাঠ ফিল্ম লেখালেখি

চার্লি চ্যাপলিনের মডার্ন টাইমস: হাসতে হাসতে রোদন

তানিয়া ইসলাম ♦ মডার্ন টাইমস নামটি এই সিনেমার জন্য একদম উপযুক্ত। এটি এমন একটি শক্তিশালী গল্প বলে যা ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশনের সময় মানুষ যেভাবে অমানবিক জীবনধারা গ্রহণ করেছিল, তা তুলে ধরে। এই যুগটি ইতিহাসের একটি বিশাল মোড় ছিল, যা প্রতিদিনের জীবনের প্রায় সব দিককে প্রভাবিত করেছিল। একথা বলা অত্যুক্তি হবে না যে মডার্ন টাইমস সিনেমাটি আধুনিক […]

Read More
অনুপ্রেরণা পাঠ বই লেখালেখি

বন্ধু বানাতে ও মানুষকে প্রভাবিত করতে ডেল কার্নেগি’র বই

দুর্বার♦ ডেল কার্নেগির সেলফ হেল্পের বই How to win friends and influence people; মানবিক দক্ষতার বইয়ের মধ্যে অন্যতম এই বইটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৩৭ সালে। প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথেই বইটির ১৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়ে যায়। বইটি এখনো ততখানিই উপযোগি যতখানি এটি প্রথম প্রকাশের সময় ছিলো, কারণ মানব প্রকৃতি নিয়ে ডেল কার্নেগির যে উপলব্ধি ছিলো […]

Read More
পাঠ লেখালেখি

কেন হিমু হাঁটে?

সাখাওয়াত হোসেন আমার কেন জানি মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে ভুল বোঝা চরিত্রটা হলো হিমু। হিমু আমরা বুঝিনি। হিমু আমরা ধরতে পারিনি। হিমু আমরা দেখতে পারিনি এবং সবচেয়ে দুঃখনজনক সত্য হলো, হিমুর একটা টুকরোও আমরা পড়তে পারিনি। হুমায়ূন ‘হিমু’কে নিয়েছিলেন সুবোধ ঘোষের ‘শুন বরনারী’ থেকে। যদিও বেশ তফাৎ আছে দুই হিমুর মধ্যে। হুমায়ূন একটা চরিত্র […]

Read More